Monday, 3 February 2014

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা চিঠি – তসলিমা নাসরিন

প্রিয় রুদ্র,
প্রযত্নেঃ আকাশ,
তুমি আকাশের ঠিকানায়
চিঠি লিখতে বলেছিলে।
তুমি কি এখন আকাশ জুরে থাকো?
তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর
মতো, পাখির মতো? তুমি এই
জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো।
তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র।
আচ্ছা, তোমার
কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না?
তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে,
আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ,
পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে?
ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস
করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না।
অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার
তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত
না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে।
ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন
পথে পথে হাটতে – হাটতে।
কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার
হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন
নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার
ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার
হাতের মুঠোয় নেই।
ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো,
তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।
আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই
প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর
প্রেম করেছিলে তোমার
যে নেলী খালার সাথে? তার
উদ্দেশ্যে তোমার
দিস্তা দিস্তা প্রেমের
কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ
কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি আর
কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার
সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম !
তাই কি? যেন আমাকেই তোমার
ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন
জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন
ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে,
আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো।
ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর
কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার
এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি।
আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন
চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার
ঘরে তোমার
বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের
কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ
ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও
তুমি কী গভীর করে বুকের
মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে ! সেদিন
আমি টের পেয়েছি।
আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন
তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে।
তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার
অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর
কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু
নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম
বলে। এই যে এখন তোমার
নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক
আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত
থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র
বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন
কোথায় ছিলো?
শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক
মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও
হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প
একদিন করলে। শুনে …
তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট
হচ্ছিলো। এই ভেবে যে,
তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো ! তার
গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব
একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার !
আজ আরেকজনের জন্য তোমার
অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার
গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো?
তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে !
আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে,
কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব
ভালো। শিমুল
মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি,
তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই
বললে, তখন আমার
কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি।
তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই
কিন্তু আর
কাউকে ভালোবাসতে পারিনি।
ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার
জিনিস নয়।
আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ !
কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন
আকাশভরা জোত্স্নায়
গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু
চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের
লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে।
“ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের
ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায়
বসে গানটি লিখেছিলে।
মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে?
আমার? নেলী খালার? শিমুলের?
অনেক দিন
ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি।
একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন
চিঠি লিখতাম। তুমিও
লিখতে প্রতিদিন। সেবার
আরমানিটোলার
বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা।
তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন
এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের
কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর
বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়।
আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না?
তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।
ইতি,
সকাল
পুনশ্চঃ আমাকে সকাল
বলে ডাকতে তুমি। কতোকাল ঐ ডাক
শুনি না। তুমি কি আকাশ
থেকে সকাল, আমার সকাল
বলে মাঝে মধ্যে ডাকো?
নাকি আমি ভুল শুন

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে ___ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয জুড়ে

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবরণে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে

পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে

ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ
দিও তোমার মালা খানি
বাউল এর এই মনটা রে

"উল্টো ঘুড়ি" ___ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ


এতো সহজেই
ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা-
দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে
স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি,
কোন বেদনার
বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ
রাত?
সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি,
সহজে ভুলিনা কিছু-
না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,
যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে
উড়াই নিজেকে আকাশের
পাশাপাশি।
সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকি না কাছে,পাছে বাঁধা
পড়ে যাই।
বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-
সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই দূরে।
আমি দূরে যাই-
স্বপ্নের চোখে তুমি মেখে নাও
ব্যথা-চন্দন চুয়া,
সারাটি রাত্রি ভাসো উদাসীন
বেদনার বেনোজলে…
এতো সহজেই
ভালোবেসে ফ্যালো কেন?

‘মায়ের কাছে চিঠি’’ ___তসলিমা নাসরিন


কেমন আছ তুমি?
কতদিন, কত সহস্র দিন
তোমাকে দেখি না মা,
কত সহস্র দিন তোমার কন্ঠ
শুনি না,
কত সহস্র দিন কোনো স্পর্শ নেই
তোমার।
তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে।
যেন তুমি থাকবেই, যতদিন
আমি থাকি ততদিন তুমি-
যেন এরকমই কথা ছিল।
আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত।
কখন আমার ক্ষিদে পাচ্ছে,
কখন তেষ্টা পাচ্ছে,
কি পড়তে চাই, কী পরতে,
কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই,
মেলতে চাই হৃদয়,
আমি বোঝার আগেই বুঝতে
তুমি।
সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের
কাছে, মুখের কাছে।
থাকতে নেপথ্যে।
তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে,
মনের আড়ালে রেখে
যত সুখ আছে সব নিয়েছি নিজের
জন্য।
তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ,
ভালবাসেনি,
আমিও দিইনি, বাসিনি।
তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ।
তুমি কি মানুষ ছিলে?
মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনোদিন,
দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান
দিতে।
যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের
কাছে,
মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে,
না চাইতেই দিতে।
একটি মিষ্টি হাসিও
তুমি পাওনি বিনিময়ে,
ছিলে নেপথ্যে,
ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে
নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা।
তুমি কি মানুষ ছিলে !
তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি,
দাবার ঘুঁটি, মানুষ ছিলে না।
তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে,
ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে,
তোমার বেদনার ভার একাই বইতে তুমি,
তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছো।
কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার,
আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যেরঅসুখ-
বিসুখ,
তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ,
আমি তো নইই, বরং তোমাকে,
তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।
তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়ে-
মাংসে-মজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই।
যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে।
যখন ছিলে, কেমন
ছিলে জানতে চাইনি।
তোমার না থাকার বিশাল পাথরের
তলে চাপা পড়ে আছে আমার দম্ভ।
যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি,
সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে,
পারিনি।
কি করে পারব বল!
আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই,
আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।

Sunday, 26 January 2014

"এখন" ___তারাপদ রায়

মনে নেই,

আমি নিজে ফিরে গিয়েছিলাম, অথবা

তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,

এখন
আর কিছু মনে নেই, তবু দুঃখ হয়

এখন, যখন একেকদিন খুব বৃষ্টি নেমে আসে

এখন, যখন একেকদিন খুব শীতের বাতাস

শুধু পাতা উড়িয়ে উড়িয়ে

আমার চারদিকে বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস
ঘুরে ঘুরে;

এমন কি যখন সেই পুরনো কালের সাদা রোদ

হঠাত্ ভোরবেলা ঘর ভাসিয়ে ছাপিয়ে,

'কি ব্যাপার এবার কোথাও যাবে না?'

এখন আর কোনোখানে যাওয়া নেই,

এখন কেবল ঠান্ডা বাতাস, এখন বৃষ্টি, জল

আমার চারপাশ ঘিরে পাতা ওড়ে আর জল পড়ে

এখন তোমার জন্য দুঃখ হয়,

এখন আমার জন্য দুঃখ হয়,

আমি নিজে ফিরে গিয়েছিলাম অথবা

তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, এখন দুঃখ হয় ।

""Opekkha"" -- Rudra Goswami

তোর চোখের মাপের
আকাশ আমি নই

তাই উড়তে বলিনি তোকে

তোর মনের মাপের
বাসাও নেই এ বুকে

তাই বসতে বলিনি আরবার

কিন্তু পাখি
তবু বলি শোন-

আমার আকাশে সীমানা
রাখিনি আমি

খাঁচাও রেখেছি খুলে

ফিরে দেখিস তোর আকাশে
ঝড় এলে...

""EKBAR TUMI"" -- SHAKTI CHATTOPADHYAY

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো-

দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর
ঝরে পড়ছে

পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল


একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।

বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো-

ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই
পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে

যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন
কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-
মাখা প্রতিমা

বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত

দেখে আসতে পারি ।


বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল

চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই -

পাথরের ফাঁক - ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল
-
অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।


মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের

বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে

আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো -

সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো

রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে

একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।